পৃথিবীতে এত পাখি থাকতে কবুতরকে শান্তির প্রতিক বলা হয় কেন?
পৃথিবীর অনেক দেশের বিভিন্ন সম্মেলন শুরু করার আগে সভাপতি বা প্রধান অতিথি কবুতর উড়িয়ে সম্মেলনের সূচনা করেন। আবার অনেক মন্ত্রিসভার সপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় কবুতর উড়িয়ে। এর কারণ হিসেবে বলা হয় কবুতর শান্তির প্রতিক, তাই কবুতর উড়িয়ে সম্মেলনের শান্তি কামনা করা হয়। এসব দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন উদয় হয়, এত পাখি থাকতে কবুতরকে কেন শান্তির প্রতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়?
আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে প্রাচিন মিশরে প্রথম কবুতরকে গৃহপালিত পাখি হিসেবে পোষা শুরু হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন কবুতর কত কাল আগে থেকেই আদুরে পাখি হিসেবে মানুষের মনে স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে কবুতরকে নিয়ে কাহিনী রচিত আছে, এর পাশাপাশি লোখমুখে প্রচলিত প্রাচিন লোকসাহিত্যে কবুতরের অনেক কাহিনী পাওয়া যায়।
যেমন প্রেমিকের চিঠি কবুতর ঠোঁটে নিয়ে প্রেমিকার বাড়িতে নিয়ে যায়। আগেকার দিনে রাজা বাদশাহরা কবুতর দিয়ে চিঠি আদানপ্রদান, এই কাহিনী গুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কবুতরকে শান্তির প্রতিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
১। গ্রিক রূপকথায় কবুতর শান্তির প্রতিক।
গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি হলো প্রেম ও রোমাঞ্চের দেবী। আফ্রোদিতির জন্ম হয় কবুতর টানা রথের উপর। আফ্রোদিতি কবুতর খুব পছন্দ করতেন। তার চারপাশে বেশিরভাগ সময় কবুতর ঘোরাঘুরি করতো।বিভিন্ন সময় তার হাতে কবুতর থাকতো। এই কারণে প্রাচিন গ্রিসের লোকজন কবুতরকে শান্তির প্রতিক মনে করতো।
২। এজটেক ধর্মে কবুতর শান্তির প্রতিক।
প্রাচীন এজটেক সভ্যতার মানুষরা মনে করতো নবী নূহ (আঃ) এর সময় মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়। মহাপ্লাবন শেষে পৃথিবী থেকে পাপ দূর হলে দেবি জোচিকুইজাল কবুতরের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।এই দেবি হলো মানবতার জননী। এই কারণে এজটেক সভ্যতার আমলে কবুতর শান্তির প্রতিক বিবেচনা করা হতো।
৩। হিন্দু পুরানে কবুতর।
হিন্দু পুরানে কবুতর প্রেম ও কামের দেবতা কামদেবের বাহন হলো কবুতর।তাই প্রাচিন ভারতের কিছু অঞ্চলের মানুষ কবুতর শান্তির প্রতিক মনে করতো।
৪। বাইবেলের বর্ণনায় কবুতর শান্তির প্রতিক।
বাইবেলের বর্ণনায় কবুতর শান্তির প্রতিক বলা হয়। বাইবেলের বর্ণনা হতে পাওয়া যায়। নবী নূহ (আঃ) তার উম্মতের পাপকার্যে বিরক্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৃথিবীকে পাপ মুক্ত করার আবেদন করেন। নূহ আঃ এর আবেদনের প্রেক্ষিতে মহান সৃষ্টিকর্তা নূহ (আঃ) কে নৌকা তৈরি করার জন্য আদেশ করেন।সৃষ্টিকর্তার আদেশে সাড়া দিয়ে নূহ (আঃ) কাঠের একটি বিরাট নৌকা তৈরি করেন।নৌকা তৈরী হয়ে গেলে তিনি প্রত্যেকটা জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সংগ্রহ করেন এবং নৌকায় তোলেন। সৃষ্টিকর্তার আদেশে আকাশ থেকে অনবরত বৃষ্টিপাত হতে থাকে।
টানা ৪০ দিন বৃষ্টিপাতের ফলে পৃথিবীর সমস্ত ভূভাগ নিমজ্জিত হয়। এবার নূহ (আঃ) স্থলভাগের খোঁজ করার জন্য নৌকা থেকে একটি কাক বাইরে প্রেরণ করেন। কিন্তু বেশ কিছু দিন পার হলেও কাকটি আর ফিরে আসে না।
দ্বিতীয়বার নূহ (আঃ) একটি সাদা কবুতরকে স্থলভাগের খোঁজ নেওয়ার জন্য নৌকা থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেন। কবুতরটি কয়েকদিন পর একটি জলপাই গাছের শাখা তার ঠোঁটে নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে। এটা দেখে নূহ (আঃ) বুঝতে পারেন যে আশপাশে কোথাও স্থল ভাগ আছে এবং পৃথিবী আর পানির নিচে ডুবে নাই। এ কারণে সাদা কবুতর শান্তির প্রতিক হিসেবে ধরা হয়।
বাইবেলের আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়,
নবী যিশুর কাছে প্রিয় ছিল সাদা কবুতর। শান্তির দূত সাদা কবুতরের রূপে পৃথিবীতে অবতরণ করে।এ কারণে সাদা কবুতর শান্তির প্রতিক হিসেবে ধরা হয়।
৫। লোকসাহিত্যে কবুতর শান্তির প্রতীক।
প্রাচীন এশিয়ায় দুইজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন।দুই রাজার শক্তির ভারসাম্য ছিল। শক্তি-সামর্থ্য, সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র এবং বুদ্ধিতে উভয় রাজা ছিলেন সমানে সমান। একদিন দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল। যথাসময়ে উভয় রাজা যুদ্ধের ডাক দিলো এবং নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য-সামন্ত জড়ো করল। প্রথম রাজা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যুদ্ধের সমস্ত পোশাক পরিধান করার পর রাজা মাথার শিরনাস্ত্র পরার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই শিরোনাস্ত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর দেখলেন তার শিরোনাস্ত্রের উপর কবুতর বাসা বেধেছে। রাজার মা রাজাকে কবুতরের বাসা ভাঙতে নিষেধ করলেন। রাজা মাতৃ আজ্ঞা পালন করে কবুতরের বাসা ভাঙ্গা থেকে বিরত থাকলেন। তিনি শিরোনাস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে রওয়ানা হলেন। দ্বিতীয় রাজা প্রথম রাজা কে খালি মাথায় যুদ্ধ করতে দেখে যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলেন। দ্বিতীয় রাজার প্রস্তাবে প্রথম রাজা সম্মত হলেন এবং আলোচনায় বসলেন।
দ্বিতীয় রাজা প্রথম রাজা কে খালি মাথায় যুদ্ধ করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। প্রথম রাজা কবুতরের ঘটনাটি খুলে বললেন। দ্বিতীয় রাজা ঘটনাটি শুনে ভাবলেন যে রাজা কবুতরের জন্য নিজের মাথার শিরোনাস্ত্র ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে খালি মাথায় উপস্থিত হয় তার মত মহৎ মানুষের সাথে যুদ্ধ করা ঠিক নয়। দুইজন রাজাই যুদ্ধ বন্ধ করলেন এবং শান্তি স্থাপন করলেন।এ কারণে প্রাচীন এশিয়ায় কবুতর শান্তির প্রতিক হিসেবে ধরা হয়।
৬। ইসলাম ধর্মে কবুতরের সম্মান
মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার সাহাবী হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে হিজরত নামে পরিচিত। নবীকে ধরার জন্য তার পিছে পিছে কাফেরদের শক্তিশালী দল ঘোড়া নিয়ে তাড়া করতে থাকে।
একসময় কাফেরদল নবীর কাছাকাছি হলে, নবী আবুবকর কে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় আশ্রয় নেন। তার আশ্রয় নেওয়ার পর গুহার মুখে কবুতর বাসা বানায় এবং ডিম পাড়ে। কাফের দল নবী কে খুঁজতে খুঁজতে নবীর আশ্রয় গ্রহণ করা গুহার সামনে চলে আসে। তারা কবুতরের বাসা এবং ডিম দেখে অনুমান করে এই গুহায় অনেকদিন থেকে কোন মানুষ প্রবেশ করেনি। তাই তারা আর না খুঁজেই ফেরত চলে যায়।
এভাবে নবীজি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ এবং কবুতরের বুদ্ধিমত্তায় কাফেরদের হাত থেকে রক্ষা পান। এ কারণে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা কবুতরকে শান্তির প্রতিক হিসেবে মনে করে।
Senior Pigeon Breeder and Admin(Only Fancy Pigeon Club in Bangladesh)
আজ এখানেই শেষ করছি আবার দেখা হবে নতুন কোন বিষয় নিয়ে। নতুন এবং প্রয়োজনীয় পোষ্ট গুলো পেতে আমাদের ব্লগটি Follow করুন এবং নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাদের সংঙ্গে থাকুন।
0 মন্তব্যসমূহ
Thanks for Commenting! please follow our blog and see update continue