কবুতর হাজারো বছর ধরে সৌখিন গৃহপালিত পাখিদের মধ্যে অন্যতম। যদিও বর্তমানে এটি শুধুমাত্র সৌখিনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই,এটি এখন সৌখিনতার পাশাপাশি বানিজ্যিক ভাবে পালন হয়ে আসছে। তবে যে,যেভাবেই কবুতর পালন করি না কেন একজন কবুতর পালকের মূল লক্ষ্য থাকে সফলতা। আর এই সফলতার মূলমন্ত্র গুলোর মধ্যে ব্রিডিং অন্যতম। আজকে আমরা আলোচনা করবো কবুতরের ব্রিডিং রেষ্ট বা বিরতি নিয়ে। আসা করি শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন।
Rest শব্দ টির বাংলা অর্থ হলো বিরতি, বিশ্রাম। এটি কবুতর পালনের সাথে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এক্ষেত্রে একটি নিদিষ্ট সময় পর পর কবুতরের ব্রিডিং বন্ধ রাখাকে কবুতরের ব্রিডিং বিরতি বা রেষ্ট বলে। তবে অনেকেই মনে করেন কবুতরের কোন রেষ্ট প্রয়োজন হয় না। আবশ্য এদের কথার সাথে আমিও ১০০% একমত । কেননা কবুতরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে ব্রিডিং একটি। এক্ষেত্রে ব্রিডিং কবুতর যদি সাভাবিক এবং প্রাকৃতিক ভাবে যেমন উন্মুক্ত আবস্থাতে লালন পালন হয়ে থাকে বা পর্যাপ্ত ভিটামিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম ও জিংকের যোগান পায় তবে ব্রিডিং কবুতরের কোন রেষ্ট এর প্রয়োজন নেই। কেননা উন্মুক্ত আবস্থাতে লালন পালন হওয়া বেশির ভাগ কবুতর বছরের একটা সময় নিজে থেকেই ব্রিডিং বিরতি দিয়ে থাকে।আসুন ব্রিডিং বিরতি সম্পর্কে ধারনা নেবার আগে আমরা কবুতরের ব্রিডিং সময় সম্পর্কে একটু আলোচনা করে আসি।
কবুতর সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাস বয়স থেকে ডিম দেয়া শুরু করে। এবং সাধারণত ৪০- ৫০ দিন পর পর ২ টি ডিম দিয়ে থাকে এবং বাচ্চা উৎপাদন করে। যদি মাঝামাঝি একটি সময় আমরা নির্বাচন করি যেমন ৪৫ তাহলে ৩৬৫ দিনে ব্রিডিং সংখ্যা দ্বারায় ৮ বার অর্থাৎ বছরের এক জোরা কবুতর ৮ বার ডিম বাচ্চা করে। কিছু ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যাতিক্রমও ঘটতে পারে যেমন ৯ -১০ বার। তবে যারা বলেন কবুতর ১২ মাসে ১৩ জোরা ডিম বাচ্চা করে আমি তাদের সাথে একমত নই।কেননা কবুতর ২৮ দিন বিরতি দিয়ে সাধারণত নতুন ডিম দেয় না। হ্যাঁ আমি তখনি তাদের সাথে একমত হবো যদি সে ডিম পারার সাথে সাথে ডিম সরিয়ে অন্য কবুতর দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে। সেক্ষেত্রে কবুতর সাধারণত ১৪ থেকে ২০ দিনে নতুন ডিম দিয়ে থাকে। তাহলে ৩৬৫ দিনে ডিম দেবার সংখ্যা দ্বারায় ১৮-২৬ বার।এক্ষেত্রে আপনার কবুতর খুব কম সময়ে ব্রিডিং ক্ষমতা হারাবে। অবাক হচ্ছেন এটি শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান মাত্র। হয়ত আপনি আমার সাথে একমত নাউ হতে পারেন। যাই হোক কবুতর যদি তার স্বাভাবিক ব্রিডিং প্রবৃত্তি ঠিক রাখে তবে আপনি ৮ -৯ বার ডিম বাচ্চা পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে আপনাকে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম,জিংক এবং সুষম খাবারের পরিপূর্ণ বন্টন করতে হবে। এখানে আপনার প্রশ্ন? তাহলে কেন কবুতরকে রেষ্ট দিব?
আমরা অধিকাংশ খামারি আমাদের কবুতর গুলোর ডিম চেলে দিয়ে ফোস্টার কবুতরের মাধ্যমে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা লালন পালন করে থাকি।বিশেষজ্ঞগন এটিকে কবুতরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বাইরে বলে উল্লেখ করেছেন। তারা মনে করেন এই কাজটি যদি আপনি প্রতিনিয়ত করতে থাকেন তবে একটা সময় আপনি দৃর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। কেননা এতে আপনার কবুতর ভিটামিন,মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ও জিংক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদানের সল্পতার পরবে এবং কবুতরটি অসুস্থ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এই কাজটির মাধ্যমে কবুতর একটা সময় বাচ্চা লালনপালন করতে অনিহা প্রাকাশ করবে। বিশেষজ্ঞগন মনে করেন আপনি যদি কোয়ালিটি সম্পন্ন ডিম বাচ্চা পেতে চান তবে সর্বনিন্ম দুই মাসে একবার ডিম বাচ্চা করানো উচিৎ। এবং এক বার ডিম বাচ্চা করার পর কম পক্ষে ১৫ - ৩০ দিন সময় তারা বিরতির দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন। এক্ষেত্রে আপনি ভালো ডিম এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম হবেন। শুধু ডিম বাচ্চা এর দিলে খেয়াল না দিয়ে এগুলোর পাশাপাশি কোয়ালিটি সম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদনে মনযোগী হওয়া প্রয়োজন কেননা কোয়ালিটি সম্পন্ন ডিম ও বাচ্চা একজন খামারির সাফল্যের চাবিকাঠি। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক অধিক ডিম বাচ্চা করার ফলে কবুতরের কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অধিক ডিম বাচ্চা উৎপাদনে কি কি সমস্যা দেখা দেয়ঃ-
১/ কবুতরের শরীরে পরিমিত মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম,জিংক,ও সালফারের অভাব দেখা দেয়।
২/ কবুতরের ডিম ছোট বড় হয়ে থাকে।
৩/ অপরিপক্ক ডিম পাড়তে পারে যা হ্যাচিং এর উপযোগী নয়।
৪/ ডিম খাওয়ার মত খারাপ অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।
৫/ডিমে তাপ প্রদানে অনীহা প্রদান করতে পারে।
৬/ নিজের বাচ্চাকে ঠোকরাতে পারে।
৭/বাচ্চা লালন-পালন করতে অস্বীকার করতে পারে।
৮/ নর মাদির জোড়া থাকা সত্ত্বেও মারামারি করতে পারে।
৯/কবুতরের উড়ন্ত দক্ষতা হ্রাস পাবে।
১০/ কবুতর ব্রিডিং ক্ষমতা চিরতরে হারাতে পারে।
১১/ সর্বপরি কোয়ালিটি সম্পন্ন ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
অনেকে কবুতর ডিম দেবার পর একটি ডিম সরিয়ে দিয়ে অন্য ডিমটি দিয়ে কবুতরকে দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে থাকেন এবং তারা ধারনা করেন একটি বাচ্চা লালনপালন করতে কবুতরের সমস্যা হয়না। তাদের উদ্দেশ্য করে বলবো। কবুতর বা যে কোন প্রানির বাচ্চা উৎপাদন করাটা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এতে উক্ত প্রানির কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তবে অধিক বাচ্চা উৎপাদন ভালো কোন বার্তা বহন করে না। অনেকে আবার মনে করেন কবুতরের মিল্ক বা ক্রপ মিল্ক তৈরি টা কবুতরের জন্য ক্ষতি কর বা কষ্ট দায়ক তাদের ব্যাপারে একই কথা কখনো কি এমনটা শুনেছেন
"যখন কোন মেয়ে মা হয় তখন তার বাচ্চার জন্য কি স্তনের দুধ পান করানো টা কষ্টদায়ক বা ক্ষতিকর??"
এমন যারা মনে করেন তাদের কাছে প্রশ্নটি রইলো আসা করি কমেন্টে উত্তর টা দিয়ে যাবেন।
যাই হোক কবুতরের ডিম উৎপাদন যদি স্বাভাবিক ভাবে হয় তবে কোন রেষ্ট এর প্রয়োজন নেই। তবে যদি প্রতিনিয়ত কোয়ালিটি সম্পন্ন ডিম বাচ্চা পেতে চাই তাহলে অবশ্যই কবুতের ব্রিডিং এর মাঝে কিছুটা বিরতি প্রয়োজন এবং এই বিরতি কালিন সময়ে তাকে পরবর্তী ডিম বাচ্চা উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা প্রয়োজন। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যায় কেন কবুতরের ব্রিডিং বিরতি বা রেষ্ট প্রয়োজন।
কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি কেন প্রয়োজনঃ-
১/ কবুতরের দীর্ঘ সময় ধরে মানসম্মত ব্রিডিং এর জন্য।
২/ রেসিং কবুতের ভালো ফলাফলের জন্য।
৩/ কবুতরের সুস্থতার জন্য।
৪/ সুস্থ বাচ্চা ও উর্বর ডিমের জন্য।
৫/ কোয়ালিটি সম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদনের জন্য।
৬/ কবুতরের ফ্লাইং পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা অধিক ডিম ও বাচ্চা নেবার ক্ষতিকারক দিক গুলো সম্পর্কে এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম।
এখন যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্মুখে আসে সেটি হলে কিভাবে বা কোন পদ্ধতিতে কবুতরের রেষ্ট দিবো। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক।
কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি এর আদর্শ মাধ্যমঃ-
এখন প্রশ্ন হলো এই বিরতি বা রেষ্ট কিভাবে দেয়া যায়? এই কথাটি অনেকে তাদের মত করে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কবুতরের ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন থেকে বিরতি বা রেষ্ট এর ক্ষেত্রে একটি শব্দ আসে তা হলো Separation অর্থাৎ বিচ্ছেদ। এখানে বিচ্ছেদ বলতে নর মাদিকে ১৫-৩০ দিন পযন্ত আলাদা রাখার ব্যাবস্থা করা।বিশেষজ্ঞ দের মতে এটিই কবুতরের ব্রিডিং বিরতি এর আদর্শ মাধ্যম।
অনেকই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি দেবার মাধ্যম বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলো আমার কাছে বিরতি বা রেষ্ট এর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে মনে হয়।
কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি এর ক্ষেত্রে কিছু মন গড়া নিয়মঃ-
১/ কবুতর ডিম দেবার পর আসল ডিম সরিয়ে নকল ডিম দিয়ে বসিয়ে রাখা।
২/ একটি ডিম সরিয়ে একটি ডিম দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করা। মনে করা হয় যে এতে কবুতরের শক্তি অপচয় কম হয়।
৩/ ডিম চেলে দেবার পরও নর মাদিকে একত্রে রাখা।
উপরোক্ত তিনটি মাধ্যমের কোনটি আমার কাছে সঠিক রেষ্ট বা বিরতি দেবার মাধ্যম বলে মনে হয়নি আসা করি আপনার মতামতটিও কমেন্টে জানাবেন।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা চারটা জিনিস সম্পর্কে ধারনা পেলাম।
১/ অধিক ডিম বাচ্চা নেবার ক্ষতিকারক দিক।
২/ কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি এর প্রয়োজনীয়তা।
৩/ রেষ্ট বা বিরতি এর আদর্শ পদ্ধত।
৪/ কবুতরের রেষ্ট বা বিরতি এর ক্ষেত্রে কিছু মন গড়া নিয়ম।
আলোচনার মধ্যম অংশে বিরতি কালিন সময়ে তাকে পরবর্তী ডিম বাচ্চা উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করার কথা বলেছিলাম। চলুন তাহলে জানা যাক বিরতি কালিন সময়ে করনীয় কাজ সমূহ।
কবুতরের বিরতি কালিন সময়ে করনীয় কাজ সমূহঃ-
১/ কবুতরকে কৃমির কোর্স করানো। ( দুই মাস পর পর)
২/ বহিঃপরজীবি দূরীকরণ এর ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে নিম পাতার দ্রবণে গোছল করানো বা বহিঃপরজীবি দূরীকরণ ঔষধ ব্যবহার করা।
৩/ লেবু,লবন,চিনির দ্রবন দেয়া।কমপক্ষে ১ দিন।
৪/ ভিটামিন, মিনারেল, ক্যালসিয়াম,জিংক ইত্যাদি পরিমিত মাত্রার সরবরাহ করা।
৫/ তুলসীপাতা, থানকুনিপাতা, এ্যালোভেরা, টকদই, সজিনাপাতা, রসুন, ইত্যাদি এর দ্রবণ দেয়া কমপক্ষে ১ দিন করে।
৬/ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার পরিবেশন করা।
৭/ উন্নত মানের গ্রিড পরিবেশন করা।
আসাকরি উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনার কবুতরের ব্রিডিং বিরতি যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করতে পারবেন। উক্ত বিষয় গুলো সম্পর্কে আপনার যদি কোন ধরনের প্রশ্ন থেকে থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। এবং পোষ্টটি অন্যের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।
আপনি আরও পড়তে পারেন:
কবুতরের ঠান্ডা জনিত সমস্যা চিকিৎসায় প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার।
অসুস্থ কবুতরের চিকিৎসায় প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং পরবর্তী পদক্ষেপ।
আপনাদের ভালোবাসাই আমদের আগামীর পথ চলার পাথেয় ।
আপনাদের সকলের শারীরিক সুস্থতা ও সকলের কবুতর গুলোর সুস্থতা কমনা করে শেষ করছি। আবার দেখা হবে নতুন কোন বিষয় নিয়ে।সবাই ভালো থাকবেন।
আল্লাহ হাফেজ
তথ্য সংগ্রহে এবং লেখকঃ-
জাকারিয়া হাসান এমরান
Admin
Pigeon Healthcare In BD
*******Thank You *******
0 মন্তব্যসমূহ
Thanks for Commenting! please follow our blog and see update continue